মরণোত্তর কিডনি সংযোজন জরুরি

বাংলাদেশে হাজার হাজার মানুষ লিভার, কিডনি, ফুসফুস অকেজো হয়ে মৃত্যুবরণ করে। এ ছাড়া প্রতিবছর প্রায় এক কোটি লোক কোনো না কোনোভাবে কিডনির রোগে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে বছরে প্রায় ৪০ হাজার রোগী সম্পূর্ণ কিডনি-বিকলতায় মারা যায়। যে হারে কিডনি-অকেজো রোগী বাড়ছে সে হারে নিকটাত্মীয়ের মধ্যে দাতা পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে হাজার হাজার রোগী অকালে মৃত্যুবরণ করছে। উন্নত বিশ্বে কিডনি রোগীদের শতকরা ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ কিডনি প্রতিস্থাপিত হয় মৃতপ্রায় ব্যক্তির কিডনি সংযোজনের মাধ্যমে। একে বলে ক্যাডাভারিক কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন। এ ব্যবস্থায় সফলতার হার শতকরা ৮৫ থেকে ৯০ ভাগ। দেশে ক্যাডাভারিক বা মরণোত্তর কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট ব্যবস্থা চালু হলে অন্তত বিপুলসংখ্যক রোগীর দাতাসংকটের সমাধান হবে। এ ক্ষেত্রে রোগীদের উন্নত প্রযুক্তি প্রয়োগ করে সুস্থ্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। কিডনি-অকেজো রোগীদের দেহে প্রতিস্থাপনে এ জন্য দেশেই চালু হওয়া দরকার ডিসিস্ট বা ক্যাডাভারিক কিডনি সংযোজন ব্যবস্থা। এটা এখন সময়ের দাবি।

ক্যাডাভারিক কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট
যখন মৃতপ্রায় ব্যাক্তির দেহ থেকে কিডনি নিয়ে জীবিত কোনো কিডনি-অকেজো রোগীর দেহে প্রতিস্থাপন করা হয় তখন তাকে ক্যাডাভারিক কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন বলা হয়। এ জন্য যে হাসপাতালে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হবে, সে হাসপাতালে একটি ব্রেইন ডেথ কমিটি ও একটি অরগান প্রকিউরমেন্ট কমিটি থাকবে। ব্রেইন ডেথ কমিটিতে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপকের সমন্বয়ে একটি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল থাকবে। আর অরগান প্রকিউরমেন্ট কমিটিতে একজন সার্জন, একজন টিস্যু টাইপিং স্পেশালিস্ট, একজন সোশ্যাল ওয়ার্কার থাকবেন। সোশ্যাল ওয়ার্কারের কাজ হবে আইসিইউতে কোনো রোগীর ব্রেইন ডেথ হওয়ার পর রোগীর নিকটাত্মীয়কে অঙ্গদানে উদ্বুদ্ধ করা। তখন তাঁরা সম্মত হলে রক্তের গ্রুপ, এইচএলএ টাইপিং ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করে নেওয়া হয়। এরপর কিডনি-অকেজো রোগী, যাঁরা প্রতিস্থাপন করতে আগ্রহী, তাঁদের সঙ্গে রক্তের গ্রুপ ও টিস্যু টাইপিংয়ের মিল বের করে সংগৃহীত কিডনিকে জীবনরক্ষাকারী মেশিনের দ্বারা কার্যক্ষম রাখা হয়। এ অবস্থ্থায় মৃত ব্যক্তির কিডনি নিয়ে বরফের ভেতর রেখে তিন থেকে ১৮ ঘণ্টার মধ্যে সংযোজনের ব্যবস্থ্থা করা হয়ে থাকে।

একসঙ্গে বাঁচতে পারে পাঁচজন
দেশে নানা দুর্ঘটনায় প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ মারা যায়। ক্যাডাভারিক বা মৃত লোকের কিডনি সংযোজনের ব্যবস্থা চালু হলে তাৎক্ষণিক সেসব মৃতপ্রায় লোকদের কাছ থেকে কিডনিসহ দরকারি অরর্গানগুলো বিযুক্ত করে হাজার হাজার মুমূর্ষু রোগীর জীবন বাঁচানো সম্ভব। মরণোত্তর কিডনি সংযোজনে আইনানুগ বা ধর্মীয় কোনো জটিলতাও নেই। কিডনির মতো হার্ট, লিভার ফেইলিওর রোগীর সংখ্যাও দেশে অগণিত। ক্যাডাভারিক পদ্ধতিতে শুধু কিডনি নয়, একই অবস্থায় অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন করা যেতে পারে। একজন মৃত ব্যক্তি পারে একসঙ্গে পাঁচজন রোগীকে বাঁচাতে। প্রথমত, তার দুটি কিডনি দুজন, একটি লিভার একজনের দেহে, একটি ফুসফুস একজনের দেহে, একটি হার্ট একজনের দেহে প্রতিস্থাপন করে ভিন্ন পাঁচজন রোগীকে বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব। এ জন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ‘ব্রেইন ডেথ কমিটি’ গঠন এবং একটি পূর্ণাঙ্গ ‘অরগান প্রকিউরমেন্ট কমিটি’ গঠন করা আবশ্যক। যে কমিটির কাজ হবে ব্রেইন ডেথ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে রোগীর নিকটাত্মীয়কে অঙ্গদানে সম্মত করা এবং তারা মত দিলেই অরগান প্রকিউরের পর তা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে তা উপযুক্ত হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া। এ পদ্ধতি কার্যকর করা গেলে বাংলাদেশে হাজার হাজার কিডনি-অকেজো রোগীসহ অন্য রোগীরা নতুন জীবন ফিরে পেতে পারে। এতে একসঙ্গে পাঁচজন রোগীকে বাঁচানো যেতে পারে।

মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন বিধান আইন
বাংলাদেশের শুধু ঢাকাতেই সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রায় ১০টিরও বেশি আইসিইউতে ১০০টির মতো বিছানা রয়েছে। এখানে নানা দুর্ঘটনা, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণসহ বহু রোগী ভর্তি হয়ে থাকে। এসব রোগীর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে কিডনি, ফুসফুস, হার্ট, লিভার প্রভৃতি অঙ্গ পাঁচ থেকে ২০ ঘণ্টা সংরক্ষণ করা গেলেই তা অকেজো অঙ্গের দেহে প্রতিস্থাপন সম্ভব। এতে হাজার হাজার রোগীর দাতাসংকটের সমাধা হওয়ার পাশপাশি এসব কিডনি-অকেজো রোগীকে নতুন জীবন দান করা সম্ভব।

অধ্যাপক এম হারুন আর রশিদ, সভাপতি, কিডনি ফাউন্ডেশন ও সোসাইটি অব অরগান ট্রান্সপ্লান্ট বাংলাদেশ

Related posts

Leave a Comment